রথযাত্রার আগের 'অনসর কাল': এক নীরব ভক্তি ও আত্মিক উপলব্ধির সময়
ভারতের বহু ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে রথযাত্রা নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আবেগঘন ও ভক্তিসম্পন্ন এক আয়োজন। পুরী শহরসহ ভারতের নানা প্রান্তে এই দিনটিকে ঘিরে উৎসব, ভক্তি আর উচ্ছ্বাসের এক অনন্য আবহ তৈরি হয়। তবে রথযাত্রার মহোৎসব শুরু হওয়ার ঠিক আগে যে সময়টা আসে, সেটি অনেক বেশি গভীর, অনেক বেশি হৃদয় ছোঁয়া। সেই সময়টিকে বলা হয়—'অনসর কাল'।
'অনসর' কথাটার অর্থ কী?
'অনসর' মানে আরোগ্য বা সুস্থ হয়ে ওঠার সময়। ভক্তদের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময়টাতে জগন্নাথদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজের মধ্যে অনুভব করেন বলেই নিজেকে আড়ালে সরিয়ে রাখেন। মন্দিরের দরজা বন্ধ থাকে, দর্শনার্থীরা ভেতরে ঢুকতে পারেন না। শুধু মন্দিরের পুরোহিতরাই নির্দিষ্ট নিয়মে দেবতার আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা ও বিশেষ পূজা করেন।
এই অনসর কাল প্রায় পনেরো দিন ধরে চলে, যেন ঈশ্বর নিজেই বিশ্রাম নিচ্ছেন—তাঁর পরবর্তী যাত্রার জন্য
একটি মর্মস্পর্শী কাহিনি
অনসর কালের পেছনে রয়েছে এক অনন্য কাহিনি। পুরাণ মতে, এক অসুস্থ ভক্ত তাঁর দৈনন্দিন কষ্টে জর্জরিত অবস্থায় জগন্নাথদেবের কাছে সহায়তা চায়। দারিদ্র্য আর অসুস্থতা সত্ত্বেও সে কখনো বিশ্বাস হারায়নি। ভক্তের এই অটল বিশ্বাসে সাড়া দেন ঈশ্বর। তিনি শুধু উপরে বসে থাকা কোন শক্তিশালী সত্তা নন, তিনি অনুভব করেন মানুষের ব্যথা।
তাঁর প্রিয় ভক্তের কষ্ট অনুভব করে জগন্নাথদেব নিজেই অসুস্থতার ভান করেন, যেন তাঁর শরীরেও সেই ব্যথার ছোঁয়া পড়ে। এর ফলে তিনি দর্শনার্থীদের থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন—একপ্রকার আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে।
দেবতার আরোগ্যের আয়োজন
এই অনসর কালে জগন্নাথদেবের শারীরিক পরিচর্যার জন্য বিভিন্ন ধরনের ভোগ নিবেদন করা হয়। ঠান্ডা খাদ্য, হালকা জলীয় ফলমূল, এবং বিশেষ আয়ুর্বেদিক ওষুধের প্রয়োগ করা হয়। যেন দেবতা ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। মন্দিরে 'শীতলতা ভোগ' দেওয়া হয়, যেটি শরীর ও মনকে শান্ত করে। এইসব আয়োজন মানুষের শরীরের পরিচর্যার মতোই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়, যেন ঈশ্বরেরও একটি মানবিক রূপ রয়েছে।
রথযাত্রা: দেবতার ফিরে আসা
অনসর কালের শেষে এসেছে সেই প্রতীক্ষিত দিন—রথযাত্রা। এদিন জগন্নাথদেব তাঁর ভাই বলরাম ও বোন সুভদ্রাকে নিজের সাথে নিয়ে বিশাল রথে চড়েন। হাজার হাজার ভক্তরা রথের দড়ি টানেন, এক অভূতপূর্ব আবেগে একদৃষ্টি জড়িয়ে ধরেন। সবাই মনে করেন, এই দড়ি টানা যেন ঈশ্বরের সাথে সরাসরি এক বন্ধনের সৃষ্টি।
পুরী শহরের সড়কের উপর সেই রথ এগিয়ে যায় গুণ্ডিচা মন্দিরের দিকে, যে ঠিক রথযাত্রার গন্তব্য। এই রথ শুধু একটি গাড়ি বলে কিছু না, এটি হয়ে ওঠে ভক্তি, ভালোবাসা আর আশার বাহন।
আমাদের জীবনের সঙ্গে এর সম্পর্ক
অনসর কাল আসলে আমাদের শেখায়—কখনো কখনো থেমে যাওয়া প্রয়োজন। জীবনে কঠিন সময় এলে, সেটা শুধুই দুর্ভাগ্য নয়, বরং আত্মবিশ্লেষণের সুযোগ। ঈশ্বর যেভাবে বিশ্রাম নিয়ে নতুন যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন, আমাদেরও দরকার এমন কিছু মুহূর্ত যেখানে আমরা নিজেকে সামলে নিতে পারি।
এই সময় আমাদের শেখায়—নিজের সঙ্গে সময় কাটানো, ধৈর্য ধরা এবং অন্যের ব্যথা বোঝা জীবনের জন্য কতটা জরুরি।

